পুষ্যভূতি বংশ (থানেশ্বর)

খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শেষ বা ষষ্ঠ শতকের সূচনায় গুপ্ত রাজবংশের পতন এবং হুন আক্রমণের ফলে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এই অরাজকতার মধ্যে পূর্ব পঞ্জাবের কুরুক্ষেত্রের কাছে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ (ইংরেজি: Pushyabhuti Dynasty) উদ্ভূত হয়। বাণভট্টের মতে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পুষ্যভূতি। এই সূত্রে এই রাজবংশকে পুষ্যভূতি রাজবংশ নামে অভিহিত করা হয়। এই বংশের সিলমোহর ও অন্যান্য বিবরণাদি থেকে যে সকল রাজার নাম জানা যায়, তারা হলেন মহারাজা নরবর্ধন (৫০০-৫২৫ খ্রিস্টাব্দ), মহারাজা রাজ্যবর্ধন (প্রথম) (৫২৫-৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ), মহারাজা আদিত্যবর্ধন (৫৫৫-৫৮০ খ্রিস্টাব্দ), প্রভাকরবর্ধন (৫৮০-৬০৫ খ্রিস্টাব্দ), রাজ্যবর্ধন (দ্বিতীয়) (৬০৫-৬০৬ খ্রিস্টাব্দ) ও হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। প্রথম দিকের মহারাজার সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজবংশের অন্যতম রাজা প্রভাকরবর্ধন প্রথম সার্বভৌম রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হন। ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যর পর এই রাজবংশের শাসন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

প্রভাকরবর্ধন(৫৮০-৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ)

  • পুষ্যভূতি বংশের প্রথম উল্লেখযােগ্য রাজা হলেন – প্রভাকরবর্ধন। তিনি 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • উত্তর ভারতের হুন, গুর্জর ও মালব রাজ্যের রাজাদেরকে পরাজিত করে রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন।
  • তিনি মালব ও গুজরাট দখল করার পর, পার্শ্ববর্তী কিছু ছোট ছোট রাজ্য দখল করেন। তিনি মৌখরী-রাজ গ্রহ বর্মণের সাথে নিজ কন্যাকে রাজ্যশ্রীর বিবাহ দেন।
  • ৬০৫ সালে হুন আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে তিনি মারা যান।

রাজ্যবর্ধন (৬০৫-৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ)

  • প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর থানেশ্বরের রাজা হন- তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন।
  • সিংহাসন লাভের পর তিনি হুনদের প্রতিহত করেন।
  • এই সময় মালবরাজ দেবগুপ্ত ও গৌড়রাজ শশাঙ্ক একযোগে মৌখরীর রাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মৌখরী-রাজ গ্রহ বর্মণ নিহত হন এবং তাঁর স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করেন।
  • রাজ্যবর্ধন এই সংবাদ পাওয়ার পর, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যবর্ধন তাঁর ছোটো ভাই হর্ষবর্ধনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে, দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দেবগুপ্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অগ্রসর হন।
  • এই সময় দেবগুপ্তকে সাহায্যের জন্য শশাঙ্কও অগ্রসর হন। কিন্তু শশাঙ্কের পৌছানোর আগেই রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাজিত করে হত্যা করেন। এরপর তিনি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তিনি শশাঙ্কের হাতে বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হয়।

হর্ষবর্ধন ( ৬০৬ – ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ )

  • ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর পো-নি বা ডান্ডি নামে এক অমাত্যের অনুরধে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন।
  • পুষ্যভূতি বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা।
  • ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি নতুন বর্ষ বা অব্দ – হর্ষাব্দ বা হর্ষ-সম্বৎ চালু করেন।
  • রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজশ্রীকে উদ্ধার ও শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন। এই সময় এর সাথে যোগ দেন কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মন। হর্ষবর্ধন বিন্ধ্যা পর্বতের জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর শশাঙ্ক ভাস্করবর্মণ ও হর্ষবর্ধনের সেনাবহিনীর আক্রমণ এড়িয়ে কনৌজ ত্যাগ করেন।
  • কনৌজের সিংহাসন শূন্য হওয়ায় তিনি ৬১২ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে কনৌজের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং এই সময়েই শিলাদিত্য উপাধি ধারণ করেন।
  • থানেশ্বের ও কনৌজ এই দুই যুগ্ম রাজ্যের রাজধানী হয় কনৌজ।
  • গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধন এবং ভাস্করবর্মন গৌড়রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দখল করে নেন। এছাড়া উড়িষ্যা আক্রমণ করে গঞ্জাম পর্যন্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন। গঞ্জাম অধিকারের পর সেখানকার মহাযান বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি সভা আহ্বান করেন। সম্মেলনের পর তিনি জয় সেন নামক জনৈক বৌদ্ধ-আচার্যকে উড়িষ্যার ৮০টি নগরীর রাজস্ব অর্পণ করেছিলেন।
  • আইহােল প্রশস্তিতে পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে “সকলোত্তরপথনাথ” ( উত্তর ভারতের প্রভু ) হিসেবে সম্মানিত করেন।
  • উত্তর ভারত জয়ের পর হর্ষবর্ধন দক্ষিণ ভারতে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি দক্ষিণ ভারতে রাজ্যবিস্তারের সংকল্প ত্যাগ করেন।
  • পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্রের বলভী রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সেখানকার রাজা ধ্রুবসেনকে পরাজিত করেন। তবে উভয়ের মধ্যে মিত্রতা স্থাপিত হয় এবং হর্ষবর্ধন নিজ কন্যার সঙ্গে ধ্রবসেনের বিবাহ দেন।
  • হর্ষবর্ধন পঞ্চভারত (থানেশ্বর, কনৌজ, মগধ, বাংলা ও উৎকল ) জয় করেন। এই কারণে হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ষণকে “পঞ্চভারতের অধিপতি” বলেছেন।
  • হর্ষবর্ধনের রাজধানী ছিল – থানেশ্বর এবং কনৌজ ( নতুন রাজধানী )
  • নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও প্রিয়দর্শিকা’ নাটক সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন – হর্ষবর্ধন।
  • ‘কাদম্বরী ও হর্ষচরিত’ রচয়িতা বাণভট্ট তাঁর সভাকবি ছিলেন।
  • বিখ্যাত চিনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাঙ(Prince of Pilgrims) হর্ষবর্ধনের রাজসভায় আসেন।
  • কনৌজ বা প্রয়াগে (গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে) প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর মেলা “মহামোক্ষ ক্ষেত্র ও দানক্ষেত্র” আয়ােজন করতেন।
  • হর্ষবর্ধন শৈব ছিলেন কিন্তু তিনি বৌদ্ধ ধর্মকেও সম্মান করতেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য তৈরী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার করেন হর্ষবর্ষণ।
  • হর্ষবর্ধনের সময়কালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন মহাস্থবির শীলভদ্র।
  • শাসন কার্য পরিচালনার জন্য হর্ষ নানা শ্রেণীর কর্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করতেন। এইসব এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অবন্তী, সিংহনাদ, কুন্তল, উপরিক, বিষয়পতি প্রমুখ।
  • রাজ-কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে ভূমিদান করা হতো।
  • শাসন কার্যের সুবিধার জন্য হর্ষ তাঁর সাম্রাজ্য কে কয়েকটি ভুক্তি বা প্রদেশ, প্রদেশ গুলিকে ‘বিষয়’ বা জেলা এবং এবং জেলা গুলিকে ‘গ্রাম’ এ বিভক্ত করেন। গ্রাম এর শাসন ভার ছিল ‘গ্রামিক’ এর হাতে। ‘করনিক’ নামক কর্মচারীর সহায়তায় গ্রামিক গ্রাম শাসন করতেন।
  • হর্ষবর্ধন সামরিক বাহিনীতে নানা সংস্কার প্রবর্তন করেন। তাঁর চারটি শাখা ছিলো: পদাতিক, অশ্বারোহী, রথী ও হস্তিবাহিনী। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান কে বলা হতো ‘কুন্তল ‘। পদাতিক বাহিনীর উচ্চ পদাধিকারীগণ-কে বলা হতো বলাধিকৃত, মহাবলাধিকৃত প্রভৃতি।
  • সাধারণ সেনারা চট ও ভট নামে পরিচিত ছিল। সামরিক বাহিনীর পদগুলি ছিলো বংশানুক্রমিক।
  • হর্ষবর্ধন এর সময় তিন ধরেনের কর বা রাজস্ব আদায় করা হতো: ভাগ, হিরন্য, বলি।
  • বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। হর্ষ এর দণ্ডবিধি ছিলো খুবই কঠোর। তবে তাঁর সাম্রাজ্যে বিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামন্ত দের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
  • ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন মারা যান। তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় তাঁর মন্ত্রী অরুনাসভ (Arunashva ) সিংহাসন যখন করেন।